সোহেল সানি ::–“তোদের আচার-আচরণ ও মেজাজ-মর্জি তো এখন এরকম হবেই, কারণ তোরা তো এখন পে-সিডেন্টের ছেলেমেয়ে।” বঙ্গবন্ধুর জীবনমরণের সহযাত্রী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব “প্রেসিডেন্ট” শব্দটি ইচ্ছে করেই ব্যঙ্গ করে উচ্চারণ করে শাসাচ্ছিলেব মেয়ে রেহানা ও শিশুপুত্র রাসেলকে। দিনটি ছিল ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। যেদিন বঙ্গবন্ধু “দ্বিতীয় বিপ্লব” ঘোষণা করে সংবিধান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনপূর্বক প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন। বেগম মুজিব ইতিপূর্বে কখনও তাঁর ছেলেমেয়েদের কাউকে ক্রুদ্ধ ও রূঢ়ভাবে বকাবকি করতে দেখা যায়নি। পুত্রকন্যাকে উপর্যুক্ত কথাগুলো বলাই শুধু নয়, আদুরে পুত্র শেখ রাসেলের খেলনার জিনিসপত্রে ভর্তি বাক্সটাও ঘরের বাইরে ফেলে দেন বেগম মুজিব। এসময় অন্যকক্ষে বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত) রাফিয়া আখতার ডলির সঙ্গে কথা বলছিলেন। যাহোক বঙ্গবন্ধুর সংসদ কক্ষেই রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণের পর স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল সংসদের শীতকালীন অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরস্থ সড়কের বাসভবনে ফিরেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। বঙ্গবন্ধু হাতমুখ ধুয়ে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে টিভি অন করতেই বেগম মুজিব হাজির হন। স্বামী বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে বলেন,”সংবিধানের এতো ব্যাপক পরিবর্তন, বিশেষ করে একদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করবে সে সম্পর্কে তুমি আমাকে একটুও আভাস দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলে না? আর তোমার তক্ষুনি সংসদ কক্ষেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার কি প্রয়োজন ছিলো? দু’চারদিন দেরী করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো? যাহোক, স্পষ্ট বলে রাখছি যে, আমি এ বাড়ী ছেড়ে তোমার সরকারী রাষ্ট্রপতির বঙ্গভবনে যাচ্ছি না।” কথাগুলো শুনে বঙ্গবন্ধু মিটমিট করে হাসছিলেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমি রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তোমাকে সবকিছু বলতে পারি না। এ কথাগুলোর সূত্র বঙ্গবন্ধুরই জ্যেষ্ঠ জামাতা ডঃ এম এ ওয়াজেদ। তাঁর একটি গ্রন্থ থেকে নেয়া। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা নিয়ে যে ঘরে বাইরে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তার আরও কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। বঙ্গবন্ধুর জামাতা অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান কান্ডারী শেখ হাসিনার মাঝেও একটা প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল সেই সময়। ২৫ জানুয়ারি রাতে ডঃ ওয়াজেদ ও শেখ হাসিনা দম্পতি ছেলেমেয়ে জয়-পুতুলকে নিয়ে ধানমন্ডির ভাড়া করা নিজেদের বাসায় চলে যান। ডঃ ওয়াজেদ শেখ হাসিনাকে বলেন, ” দেশের একজন সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমার তোমাদের সবাইকে জানানো প্রয়োজন বলে মনে করি যে, তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) দেশে একদলীয় রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা কোনমতেই সমীচীন, যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত হয়নি বা হবে না। কাজেই সংবিধান চতুর্থ সংশোধনী সত্ত্বেও উচিত হবে না দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করা। শেখ হাসিনা ২৬ জানুয়ারি সকালবেলায় পিতার সঙ্গে দেখা করে কথাগুলো বলেন। বঙ্গবন্ধু মেয়ের কথা শুনে বলেন, ওকে (জামাইকে) বলো, দেশের এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা শুধু স্বল্পকালের জন্য। শেখ হাসিনা বাসায় ফিরে স্বামীকে বলেন, “তুমি যেন এ ব্যাপারে অযথা উত্তেজিত না হও এবং দুশ্চিন্তা না করো। আব্বার এই কথাগুলো যেন কারোর কাছে জানাজানি না হয়ে যায় সেজন্য তিনি তোমাকে সর্বদা সংযত ও হুশিয়ার থাকতে বলেছেন অন্যের সঙ্গে কথাবার্তায়। বঙ্গবন্ধু ওদিনই বিকেলে মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১১ ফেব্রুয়ারী জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিবাদ করে সংসদ সদস্য পদে ইস্তফা দেন। কিন্ত অনেকেই একদলীয় শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করে আসলেও সংসদ সদস্য পদ হারানোর ভয়ে পক্ষেই ভোট দেন। তাদের প্রায় সবাই মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেন। কমরেড মনি সিং এর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি – ন্যাপ বাকশালে যোগ দিলে জাতীয় সংসদের ৮ জন বিরোধী সদস্যের ৪ জন প্রবীণ নেতা অধুনালুপ্ত পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, জাসদের আব্দুস সাত্তার, সৈয়দ কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও মিস্টার খোয়াই বেয়োজরও বাকশালে যোগদান করেন। যাহোক একদলীয় শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেও যারা বাকশালের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই তাদের স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করছি। তবে ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বরাত দিয়ে শেখ হাসিনা তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আপনার জামাই বলেছেন, বঙ্গবন্ধু দেশ বিদেশে একজন জাতীয়তাবাদী গনতন্ত্রী ও প্রগতিশীল মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরূপে পরিচিত। সারা বিশ্বের যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এতো সম্মান মর্যাদা দিয়েছেন, যাদের মধ্যে বিভ্রান্তি শুধু নয়,তাঁর ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হয়ে যাবে। দাতা দেশগুলো সরকারকে যে অর্থ প্রযুক্তি সাহায্যদানে ইতস্ততই শুধু করবে না, বরং এদের কেউ কেউ তা একেবারে বন্ধও করে দিতে পারে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বিকেল পশ্চিম জার্মানির উদ্দেশ্যে ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। অপরদিকে একই বছর ২৯ জুলাই ঢাকা ত্যাগ করেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা (দুইশিশুসন্তানসহ), শেখ রেহানা। ১৯৭৫ সালে বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে ১৮ জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা শুরু হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আলোচনার সূত্রপাত করেব এই বলে যে,”বঙ্গবন্ধু”, আপনি সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে যাচ্ছেন সেটা কি এবং কেন তা নিজ মুখে বলুন। আপনি যা বলবেন তা গৃহীত হবে এবং পরে আইনে পরিণত করা হবে।” বঙ্গবন্ধু তখন বলেন, “আমি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে আগ্রহী, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাই। যারা আমার বক্তব্য সমর্থন করো, তারা হাত উঠাও।” পলকের মধ্যে সবার হাত উঠে গেলো। সভায় ইতিপূর্বে নৌপরিবহন মন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত জেনারেল এমএজি ওসমানী একদলীয় শাসনপদ্ধতি নিয়ে বলেন, “আমরা আইউব খানকে দেখেছি, ইয়াহিয়া খানকে দেখেছি, আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুজিবুর রহমানখান হিসেবে দেখতে চাই না।” বঙ্গবন্ধু সভা কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতা প্রাপ্তির পর পরই বৈঠক শেষ করে সংসদ নেতার কক্ষে চলে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধু জেনারেল ওসমানীকে তলব করেন। তিনি ওসমানীর উদ্দেশ্যে বলেন,” Don’t be excited my old friend, people are fed up…